বুধবার, ২৫ জুন, ২০২৫  |   ৩১ °সে

প্রকাশ : ২৫ জুন ২০২৫, ১৩:৪৭

১২ দিনের ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ কি সত্যিই শেষ? কে কী অর্জন করল?

১২ দিনের ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ কি সত্যিই শেষ? কে কী অর্জন করল?
অনলাইন ডেস্ক

মধ্যপ্রাচ্যে টানা প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে চলমান উত্তেজনাপূর্ণ যুদ্ধে গত রোববার থেকে উত্তাপ কমে আসে এবং অবশেষে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে সংঘাতের আপাতত অবসান হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এটিকে “১২ দিনের যুদ্ধ” বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই যুদ্ধ শেষ হয়েছে বলে দাবি করেছেন ট্রাম্প, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং ইরানের নেতারা। তারা প্রত্যেকেই নিজেদের শর্তে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে বলে দাবি করছেন।

কিন্তু আসল ঘটনা কী? ইসরায়েল কী অর্জন করল? ইরান কি তাদের কৌশলগত পারমাণবিক সম্পদ রক্ষা করতে পারল? আর এই যুদ্ধবিরতি কি শান্তির পথ খুলে দেবে?

ঘটনাপ্রবাহ

গত শনিবার রাতে ইসরায়েলের অনুরোধে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ফোর্দো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়, যা ট্রাম্পের ভাষায় “পুরোপুরি ধ্বংস” করে দেওয়া হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় সোমবার ইরান কাতারে অবস্থিত মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তম মার্কিন বিমানঘাঁটি আল উদেইদে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে।

মনে হচ্ছিল, মধ্যপ্রাচ্য হয়তোবা একটি দীর্ঘ ও বিস্তৃত যুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ট্রাম্প তার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যালে’ ঘোষণা করেন, “ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে একটি সম্পূর্ণ এবং চূড়ান্ত যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে।”

তিনি এই যুদ্ধকে “১২ দিনের যুদ্ধ” বলে অভিহিত করেন, যা তার মতে, “কয়েক বছর ধরে চলতে পারত এবং মধ্যপ্রাচ্যকে ধ্বংস করে দিত”।

যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার চার ঘণ্টা পর ইসরায়েল পাল্টা হামলা চালায়। ইসরায়েলের দাবি, ইরান থেকে দুটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তাদের আকাশসীমায় প্রবেশ করেছিল (যা প্রতিহত করা হয়েছে)। এর জবাবে ইসরায়েল তেহরানের কাছে একটি রাডার স্টেশন ধ্বংস করে।

এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, “আমি সত্যিই অসন্তুষ্ট যে ইসরায়েল আজ সকালে হামলা করেছে”। তিনি আরও বলেন, “দুটি দেশ এত দীর্ঘ সময় ধরে কঠোর লড়াই করছে যে তারা জানে না তারা কী করছে।”

অবশ্য ইরান এই ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের কথা অস্বীকার করে। এরপর যুদ্ধবিরতি আবার কার্যকর হয়। ট্রাম্প নেতানিয়াহুর সঙ্গে কথা বলেন এবং ট্রুথ সোশ্যালে লেখেন, “ইসরায়েল ইরানের ওপর হামলা চালাবে না। সমস্ত বিমান ফিরে আসবে এবং ইরানকে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ‘প্লেন ওয়েভ’ দেবে। কেউ আঘাত পাবে না, যুদ্ধবিরতি কার্যকর!”

ইসরায়েল কী অর্জন করল?

ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে ইরানকে তাদের অস্তিত্বের জন্য প্রধান হুমকি বলে দাবি করে আসছে, কিন্তু এর আগে কখনও তেহরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়নি তারা। গত ১৩ জুন তারা এই “রেড লাইন” অতিক্রম করে নাতাঞ্জ জ্বালানি সমৃদ্ধকরণ প্ল্যান্ট এবং ইসফাহান পারমাণবিক প্রযুক্তি কমপ্লেক্সের উপরিভাগের স্থাপনায় বোমা হামলা চালায়।

ইরান এর জবাবে ইসরায়েলের দিকে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। ইসরায়েল অবশ্য এর আগেও সিরিয়া ও ইরাকের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে, কিন্তু এবার তারা আরও অনেক দূরে একটি জটিল অভিযান চালাতে সক্ষম হয়েছে।

আন্তর্জাতিক সমালোচনা সত্ত্বেও, ইসরায়েল দাবি করে- আত্মরক্ষার জন্য এটি আগাম হামলা ছিল। যদিও সবাই একমত নন যে ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরি করছে বা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অবিলম্বে এটি ব্যবহার করার পরিকল্পনা করছে।

নেতানিয়াহু গত ১৮ জুন বলেন, “আমি বিশ্বনেতাদের সঙ্গে কথা বলছি এবং তারা আমাদের সংকল্প ও আমাদের বাহিনীর অর্জনে মুগ্ধ।”

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ইসরায়েল প্রমাণ করেছে যে তারা যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের শুরু করা একটি সীমিত মধ্যপ্রাচ্য অভিযানে যুক্ত করতে পারে। এর আগে ১৯৬৭ এবং ১৯৭৩ সালের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে বস্তুগত সহায়তা দিয়েছিল, কিন্তু সরাসরি সামরিক অভিযানে অংশ নেয়নি। আর তাই এবারের সংঘাতে নেতানিয়াহু “আমাদের পাশে থাকার জন্ “ ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানান।

ইরানের বিরুদ্ধে “অপারেশন রাইজিং লায়ন” এমন সময়ে শুরু হলো যখন ইসরায়েল ইরানের আঞ্চলিক মিত্র যেমন, ইয়েমেনের হুথি, গাজার হামাস এবং লেবাননের হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে সংঘাতে লিপ্ত ছিল। গত দুই বছরে হামাস ও হিজবুল্লাহ দুর্বল হয়েছে।

ইরান কি তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি রক্ষা করতে পেরেছে?

ইসরায়েল ইরানের উপরিভাগের লক্ষ্যবস্তুগুলোর উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছে, তারা ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করেছে। তবে স্যাটেলাইট ছবিতে ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানার প্রমাণ পাওয়া গেলেও, কী কী ধ্বংস হয়েছে তা যাচাই করার জন্য স্বাধীনভাবে কিছুই নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এর জন্য ঘটনাস্থলে পরিদর্শনের প্রয়োজন।

মার্কিন হামলার পর সোমবার জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষণ সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি (আইএইএ)-এর মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি বলেন, “এই মুহূর্তে আইএইএ-সহ কেউই ফোর্দোর ভূগর্ভস্থ ক্ষতির সম্পূর্ণ মূল্যায়ন করতে পারেনি।”

তিনি আরও বলেন, “হামলায় ব্যবহৃত বিস্ফোরক এবং সেন্ট্রিফিউজগুলোর চরম কম্পন-সংবেদনশীল প্রকৃতির কারণে খুব উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।”

এছাড়াও আইএইএ জানিয়েছে, ইরানের কাছে বর্তমানে ৪০০ কিলোগ্রাম (৮৮০ পাউন্ড) উচ্চ-সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম রয়েছে, যার বর্তমান অবস্থান অজানা। অর্থাৎ সেগুলো কোথায় আছে কেউ জানে না।

ইরানের আণবিক শক্তি সংস্থার প্রধান মোহাম্মদ এসলামি ইঙ্গিত দিয়েছেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি অক্ষত থাকবে। মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “কর্মসূচি পুনরুদ্ধারের প্রস্তুতি ইতোমধ্যেই নেওয়া হয়েছে এবং আমাদের পরিকল্পনা হলো উৎপাদন বা পরিষেবাতে কোনো বাধা সৃষ্টি না করা।”

এদিকে মঙ্গলবার সকালে যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার সাড়ে তিন ঘণ্টা পর ইসরায়েলে আঘাত হানা দুটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের উৎস নিয়ে এখনো বিভ্রান্তি রয়েছে। ইরানের সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এই ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের কথা অস্বীকার করেছে। তাহলে কে এটি নিক্ষেপ করল?

আর সেগুলো কি দুর্ঘটনাক্রমে নিক্ষেপ করা হয়েছিল কিনা এমন প্রশ্নও উঠেছে। যেমন ২০২১ সালে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ভুলবশত একটি ইউক্রেনীয় যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত করেছিল, যাতে ১৭৬ জন নিহত হয়েছিলেন।

ইরানের ওপর আরেকটি হামলার আশঙ্কা কতটা?

ইসরায়েল ও ইরান যা সম্মত হয়েছে তা হলো একটি যুদ্ধবিরতি, শান্তি নয়। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুটি সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ পথ রয়েছে।

একটি পথ হলো, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর পুনরায় জাতিসংঘ পরিদর্শন এবং ইরানের সঙ্গে একটি নতুন চুক্তি, যা সম্ভবত ২০১৫ সালের তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ)-এর মতো হতে পারে।

এটি তেহরানকে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর বৈশ্বিক চাপ কমাতে সাহায্য করতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, ইরান নয়, ট্রাম্প নিজেই জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন বা জেসিপিওএ থেকে সরে এসেছিলেন।

এখানে ইউরোপীয় শক্তিধর দেশগুলো একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং জার্মানি গত ২০ জুন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচির সঙ্গে বৈঠক করে মার্কিন হামলা এড়ানোর চেষ্টা করেছিল। সেই বৈঠকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি প্রধান কায়া ক্যাল্লাসও ছিলেন।

তবে সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলেও, ইইউ একা ইরানকে আপস করতে বাধ্য করতে না পারলেও, মার্কিন-ইসরায়েলি শক্তির বিরুদ্ধে একটি পাল্টা শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে গোষ্ঠীটি।

এথেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-রাজনীতি বিষয়ের সহযোগী প্রভাষক ইয়ানিস কোটৌলাস আল জাজিরাকে বলেন, “ইরান উন্নত পর্যবেক্ষণ প্রস্তাব করে এবং তাদের পারমাণবিক কর্মসূচিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে ইউরোপীয়দের কূটনৈতিকভাবে জড়িত করার চেষ্টা করবে।”

তিনি আরও বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র একটি শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে– (মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো) রুবিও ইতোমধ্যেই তা বলেছেন। সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্র সরকার পরিবর্তনের চেষ্টা করবে না। ইউরোপই এখন ইরানের একমাত্র পথ। রাশিয়া অবিশ্বস্ত।”

তবে ইসরায়েল অতীতে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের যেকোনো পারমাণবিক চুক্তি বানচাল করার চেষ্টা করেছে এবং নতুন চুক্তি সহজে মেনে নেবে না।

আর যুক্তরাষ্ট্র আগের পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে আসা, সাম্প্রতিক আলোচনায় লক্ষ্যবস্তু পরিবর্তন করা এবং তারপর একটি চুক্তির আলোচনা চলার সময়ে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে ইসরায়েলের বোমা হামলা চালানোর পর তেহরান কি আদৌ কোনো আপসে রাজি হবে?

সেন্ট অ্যান্ড্রুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরানি ইতিহাসের অধ্যাপক আলী আনসারি আল জাজিরাকে বলেন, “এটি সত্যিই দেশের অভ্যন্তরীণ গতিশীলতার ওপর নির্ভর করে, তবে দেশের ভেতরের কর্মীরা ইতোমধ্যেই ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন।”

তবে এখন পর্যন্ত ইরান তাদের পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়ে অনড় বলে মনে হচ্ছে। সোমবার ইরানের সংসদের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি একটি বিল অনুমোদন করেছে, যেখানে তারা জাতিসংঘের পরমাণু সংস্থার সঙ্গে তেহরানের সহযোগিতা সম্পূর্ণ স্থগিত করার কথা বলেছে।

এদিকে, মঙ্গলবার ট্রাম্প সোশ্যাল মিডিয়ায় জোর দিয়ে বলেছেন, তিনি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি পুনরায় শুরু করতে দেবেন না। যদি এই মৌলিক উত্তেজনা অব্যাহত থাকে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের আরেক দফা হামলা-পাল্টা হামলা কেবল সময়ের ব্যাপার হতে পারে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়