রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪  |   ২৮ °সে

প্রকাশ : ৩০ জুন ২০২২, ১১:৩৪

‘ফিলিপাইনের ট্রাম্প’ দুতার্তের যত সমালোচিত কর্মকাণ্ড

‘ফিলিপাইনের ট্রাম্প’ দুতার্তের যত সমালোচিত কর্মকাণ্ড
অনলাইন ডেস্ক

ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে রদ্রিগো দুতার্তের ছয় বছরের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আজ বৃহস্পতিবার। দুতার্তের স্থলাভিষিক্ত হবেন সাবেক স্বৈরশাসক ফার্দিনান্দ মার্কোসের ছেলে ফার্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়র। কঠোরভাষী ও আত্মস্বীকৃত হত্যাকারী হিসেবে ব্যাপক সমালোচিত দুতার্তে। তাঁর নির্দেশে মাদকবিরোধী অভিযানে হাজারো মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকাসক্ত ব্যক্তি নির্বিচার হত্যার শিকার হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ভাষণে ধর্ষণ নিয়ে ঠাট্টা–তামাশা করা, নারী বিদ্বেষী বক্তব্য এবং সমালোচনাকারীদের কারাবন্দী করে রাখার কারণেও সমালোচিত ৭৭ বছর বয়সী এ নেতা। তাঁর শাসনামলেই কয়েক দশকের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে ফিলিপাইন।

অনেকেই তাঁকে ফিলিপাইনের ডোনাল্ড ট্রাম্প হিসেবে ডেকে থাকেন। তবে এত কিছুর পরও রদ্রিগো দুতার্তের জনপ্রিয়তায় খুব একটা প্রভাব পড়েনি। বিভিন্ন জনমত জরিপের ভিত্তিতে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট দুতার্তের জনপ্রিয়তা সব সময় ৫০ শতাংশের বেশি থাকতে দেখা গেছে।

দুতার্তের সমালোচিত কিছু কর্মকাণ্ড একনজরে দেখে নেওয়া যাক—

মাদকবিরোধী যুদ্ধ এবং নির্বিচারে হত্যার নির্দেশ

২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন রদ্রিগো দুতার্তে। নির্বাচনী প্রচারণায় ফিলিপাইনকে মাদক সমস্যা থেকে মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এ নেতা। প্রকাশ্যে বলেছিলেন, মাদকবিরোধী অভিযানে গিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা যদি মনে করেন তাঁদের জীবন হুমকিতে আছে, তবে সন্দেহভাজনদের মেরে ফেলতে পারবেন তাঁরা।

সরকারি হিসাবে দেখা গেছে, পুলিশের মাদকবিরোধী অভিযানে কমপক্ষে ৬ হাজার ২৪৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, লাখো মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছে পুলিশ। এমনকি মাদকসংশ্লিষ্টতার প্রমাণ নেই এমন মানুষকেও হত্যা করা হয়েছে।

দুতার্তে প্রশাসনের মাদকবিরোধী অভিযান নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে তুমুল সমালোচনা হয়েছে। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তদন্তও হয়েছে। অবশ্য ফিলিপাইনের অনেক মানুষ তাঁর এ মাদকবিরোধী অবস্থানকে স্বাগত জানিয়েছেন।

লাগামহীন কথাবার্তা, গুলি করার হুমকি

লাগামহীন কথাবার্তা, বর্ণবাদী কৌতুক বলা এবং কথায় কথায় গুলির হুমকি দিয়ে নানা সময়ে বক্তব্য দিয়েছেন দুতার্তে। তাঁকে নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে। তাঁর কিছু বিতর্কিত মন্তব্য—

২০১৬ সালের ৩০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মাথায় একটি বস্তি পরিদর্শনে যান দুতার্তে। সেখানে তিনি ফিলিপাইনের জনগণের প্রতি আহ্বান জানান তাঁরা যেন মাদকসেবীদের হত্যা করেন। তিনি বলেন, ‘আপনারা যদি কোনো মাদকাসক্ত সম্পর্কে জানতে পারেন, তবে নিজেরাই এগিয়ে যান। আপনারা নিজেরাই তাদের হত্যা করুন। তাদের মা-বাবার জন্য কাজটি করাটা অনেক যন্ত্রণার হবে।’

২০১৬ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর দুতার্তে ইঙ্গিত করেছিলেন, জার্মান একনায়ক হিটলার যেভাবে ইহুদি নিধন চালিয়েছিলেন, তেমনি করেই মাদকবিরোধী অভিযান চালাবেন তিনি।

দুতার্তে বলেন, ‘হিটলার ৩০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করেছেন। এখানেও (ফিলিপাইন) ৩০ লাখ মাদকাসক্ত আছে। তাদের মেরে ফেলতে পারলে আমি আনন্দিত বোধ করব।’

২০২০ সালের ১ এপ্রিল করোনা মহামারি মোকাবিলায় জারি করা লকডাউনের বিরোধিতাকারীদের গুলি করার জন্য পুলিশ ও সেনাসদস্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন দুতার্তে। তিনি বলেন, ‘পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং গ্রাম কর্মকর্তাদের প্রতিও আমার নির্দেশনা থাকবে এমন কোনো পরিস্থিতি যদি হয় যে জনগণ বিরোধিতা করছে এবং আপনাদের জীবন হুমকিতে আছে, তবে তাদের গুলি করে মেরে ফেলুন।’

দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের হুমকি দিয়ে দুতার্তে বলেছিলেন, ‘আপনারা যদি দুর্নীতি করেন, তবে আপনারা যে–ই হোন না কেন, আমি হেলিকপ্টারে করে ম্যানিলায় নিয়ে যাব। আপনাদের ওপর থেকে ফেলে দেব আমি। আগেও এমন করেছি, আবারও নয় কেন?’

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেনাসদস্যদের উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে দুতার্তে বলেছিলেন, সেনাদের উচিত নারী কমিউনিস্ট বিদ্রোহীদের যৌনাঙ্গে গুলি করা।

২০১৮ সালের জুনে দক্ষিণ কোরিয়ায় এক অনুষ্ঠানে ফিলিপাইনের এক প্রবাসী নারী শ্রমিককে চুমু খেয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন দুতার্তে।

দারিদ্র্য মোকাবিলায় ব্যর্থতা

রদ্রিগো দুতার্তে দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম কয়েক বছরে লাখো মানুষ দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছিলেন। ফিলিপাইনের পরিসংখ্যান কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে দারিদ্র্যের হার ২৩ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল। ২০১৮ সালে তা কমে ১৬ দশমিক ৭ শতাংশে দাঁড়ায়। তবে করোনা মহামারির কারণে আবারও মুখ থুবড়ে পড়ে দেশটির অর্থনীতি। দেশটির দ্ররিদ্র মানুষের আর্থিক দুর্দশা আরও বাড়তে থাকে।

১১ কোটি জনসংখ্যার দেশটিতে গত বছর আবারও দারিদ্র্যের হার বেড়ে ২৩ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছেছে।

২০২২ সালের প্রথম তিন মাসে ফিলিপাইনের ৪৩ শতাংশ পরিবার বলেছে, তারা নিজেদের দরিদ্র বোধ করছে। ৩৪ শতাংশ মানুষ মনে করে, তারা দারিদ্র্যসীমার মধ্যে আছে।

অবকাঠামো

করের অর্থ ও বিদেশি ঋণের সহায়তায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন শুরু করেন। ৮-৯ লাখ কোটি পেসো ব্যয়ে ‘বিল্ড, বিল্ড, বিল্ড’ ক্যাম্পেইন পরিচালনা করেন তিনি।

উন্নয়নের জোয়ারের অংশ হিসেবে হাজারো সেতু, বাঁধ, শ্রেণিকক্ষ, আশ্রয়কেন্দ্র ও রাস্তাঘাট নির্মাণ করা হয়েছে।

ফিলিপাইনের গণপূর্ত ও মহাসড়কবিষয়ক বিভাগ (ডিপিডব্লিউএইচ) বলেছে, দুতার্তের প্রশাসন প্রথম চার বছরে ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি পেসো মূল্যের সরকারি অবকাঠামোর কাজ শেষ করতে পেরেছে। দুতার্তের আগের প্রশাসন একই সময়ের মধ্যে ৮২ হাজার ৪০ কোটি পেসো অবকাঠামো খাতে খরচ করেছিল।

তবে দুতার্তে সরকারের অনেকগুলো প্রকল্পই গর্তে পড়েছে। সম্প্রতি ডিপিডব্লিউএইচ বলেছে, ১১৯টি অবকাঠামো প্রকল্পের মধ্যে ১২টির কাজ শেষ হয়েছে।

করোনা মহামারি মোকাবিলা

করোনা মহামারি মোকাবিলায় বিভিন্ন পদক্ষেপে নেতৃত্ব দিতে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের বদলে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের নিয়োজিত করেছিলেন দুতার্তে। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশ। শুরুতেই টিকার সংকট নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন দুতার্তে। এ ছাড়া মহামারি মোকাবিলায় লকডাউন ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কঠোর বিধির কারণে ব্যবসা খাতও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

তিন দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে পড়ে ফিলিপাইনের অর্থনীতি। লাখো মানুষ চাকরিহীন হয়ে পড়েন।

২০২২ সালের ২৭ মে নাগাদ ৭ কোটি ৮ লাখ মানুষ পুরোপুরিভাবে টিকা নিতে সক্ষম হন। প্রতিবন্ধকতা প্রত্যাহারের পর অর্থনীতি আবার আগের অবস্থায় ফিরতে শুরু করে।

চীন

দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চীন ও ফিলিপাইনের মধ্যে বিরোধ থাকলেও দুতার্তে দায়িত্ব নেওয়ার পর দুই দেশের সম্পর্ক উষ্ণ হতে থাকে। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ জোরদারের আশায় বিরোধকে এক পাশে সরিয়ে রেখেছিলেন তিনি। চীন ভিত্তিহীনভাবে দক্ষিণ চীন সাগরের বেশির ভাগ এলাকার মালিকানা দাবি করছে বলে আন্তর্জাতিকভাবে যে রুল জারি করা হয়েছিল, তা–ও উপেক্ষা করেছেন দুতার্তে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ একটি সামরিক চুক্তি বাতিলেরও হুমকি দিয়েছিলেন তিনি। এতে আঞ্চলিক নিরাপত্তা হুমকিতে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।

নিজের শাসন মেয়াদের শেষ বছরে চীনের প্রতি আরও দৃঢ় অবস্থান দেখিয়েছেন দুতার্তে।

এতে দক্ষিণ চীন সাগরে মালিকানা নিয়ে বিভিন্ন দেশের মধ্যে উত্তেজনা জোরদার হয় এবং তাঁর ওপর অভ্যন্তরীণ চাপ বাড়ে।

একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভিজিটিং ফোর্সেস চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন ফিলিপাইনের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট।

সূত্র: এএফপি, বিবিসি, গার্ডিয়ান

অনুবাদ: প্রথম আলো

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়