মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪  |   ৩৬ °সে

প্রকাশ : ২৫ জানুয়ারি ২০২৩, ০৩:৫৪

জঙ্গিদের হাতে ভারী অস্ত্র মাথায় কাফনের কাপড়

জঙ্গিদের হাতে ভারী অস্ত্র মাথায় কাফনের কাপড়
অনলাইন ডেস্ক

জঙ্গিদের নতুন প্ল্যাটফর্ম জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারকস্ফীয়ার দুই শীর্ষ নেতাকে গ্রেপ্তারের পর পার্বত্য অঞ্চলের সামরিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের ভিডিও জব্দ করা হয়েছে।

গণমাধ্যমের হাতে আসা দুটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, তাঁরা গহিন বনে ঘোরাঘুরি করছেন। কারও হাতে অস্ত্র, কারও মাথায় কাফনের কাপড়। সব তরুণের চোখ-মুখ হাস্যোজ্জ্বল। নিজেরা রান্না করছেন, আড্ডা দিচ্ছেন ও খাওয়া-দাওয়া করছেন। পাহাড়ে তৈরি বাঙ্কারে কেউ কেউ পাহারা বসান। বিশাল কড়াইয়ে বনের ভেতরে কথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে ঘরছাড়া তরুণরা গরুর মাংস রান্না করছেন। কোনো তরুণের কাঁধে ভারী অস্ত্র। তাঁরা কাঠের তৈরি ক্যাম্প পাহারা দিচ্ছেন। কারও গায়ে কমব্যাট ড্রেস। এ সময় রাতের আঁধারে একজনকে গাইতে শোনা যায়, 'মাথায় কাফন বেঁধে জঙ্গি মিশন দুনিয়াতে ছড়িয়ে দাও।'

গত সোমবার কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে র‌্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার হন নতুন জঙ্গি সংগঠনের সামরিক শাখার প্রধান মাসুকুর রহমান মাসুদ ওরফে রনবীর ও বোমা বিশেষজ্ঞ আবুল বাশার মৃধা। এর পর তাঁদের মোবাইল থেকে পাহাড়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের ভিডিও জব্দ করা হয়। নতুন এ জঙ্গি সংগঠনটি নিষিদ্ধ করতে উদ্যোগ নিচ্ছে প্রশাসন। পুলিশ সদরদপ্তর থেকে নথি যাওয়ার পরে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

ভিডিওর ব্যাপারে জানতে চাইলে র‌্যাবের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, ছোট ছোট এই ভিডিওগুলো তিন-চার মাস আগের তৈরি। বড় ধরনের হামলা করে অস্ত্রসহ এসব ভিডিও প্রকাশ করে 'দায় স্বীকারের' পরিকল্পনা ছিল তাদের। বিশেষ করে কাশিমপুর কারাগারে একযোগে জঙ্গি হামলা চালিয়ে উগ্রপন্থিদের ছাড়িয়ে নেওয়ার ছক কষেছিলেন তাঁরা। অস্ত্র প্রশিক্ষণের অধিকাংশ ভিডিও নতুন জঙ্গি সংগঠনের সামরিক প্রশিক্ষক রনবীরের ডিভাইস থেকে পাওয়া গেছে। ভিডিওতে ৩০-৩৫ জন তরুণকে দেখা গেছে। ঘরছাড়া তরুণদের যে নিখোঁজ তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল, তাঁদেরও ছবি সামরিক প্রশিক্ষণের ভিডিওতে রয়েছে। ভিডিওতে যাঁদের দেখা গেছে, তাঁদের মধ্যে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা গেছে। তাঁরা হলেন- সালেহ আহমেদ, নিজাম উদ্দিন ও আবুল বাশার মৃধা।

গতকাল মঙ্গলবার কারওয়ান বাজারে মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তার রনবীর প্রথম জীবনে ছিলেন 'ডাকাত'। কারাবন্দি অবস্থায় আরেক জঙ্গি সংগঠন জেএমবির শীর্ষনেতাদের সংস্পর্শে এসে তিনিও উগ্রবাদে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর বাড়ি সিলেটে। ২০০৭ সালের আগে ডাক বিভাগে চাকরি করতেন। পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় ডাকাতি করতেন। ডাকাতির অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা হয়। ওই মামলায় ২০০৭-পরবর্তী সময়ে কয়েক দফায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগ করেন রনবীর। জামিনে বের হওয়ার পর জেএমবির জন্য কাজ শুরু করেন। মূলত জেএমবির যেসব সদস্য কারাগারে আছেন, তাঁদের পরিবারের দেখভাল করতেন তিনি। কারাবন্দি জেএমবি সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগও রক্ষা করতেন। জামাতুল আনসারের এখনকার বর্তমান শূরা সদস্য এবং অর্থ ও মিডিয়া শাখার প্রধান মোশাররফ হোসেন ওরফে রাকিবের সঙ্গে ২০১৭ সালে পরিচয় হয় রনবীরের। রাকিবের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য হিসেবে জামাতুল আনসারে যোগ দেন তিনি।

কমান্ডার মঈন আরও বলেন, রনবীর সিলেট অঞ্চলে সংগঠনের দাওয়াতি ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমসহ সামরিক শাখার সদস্য নির্বাচন করতেন। শুরু থেকে সংগঠনের সামরিক শাখার বিভিন্ন নীতি-নির্ধারণী বিষয়ে বড় ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। সংগঠনের আমিরের নির্দেশনায় কুমিল্লার পদুয়ার বাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শূরা কমিটির সভার আয়োজন করেন তিনি। ২০২১ সালে পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী দল কেএনএফ বা বমপার্টির সঙ্গে জামাতুল আনসারের প্রশিক্ষণের ব্যাপারে যে চুক্তি হয়, সেখানেও সংগঠনের আমির ও অন্যান্য শূরা সদস্যদের সঙ্গে রনবীর উপস্থিত ছিলেন।

কারাগারে গিয়ে সাধারণ অপরাধীদের জঙ্গিবাদে জড়ানোর আরও ঘটনা শোনা যাচ্ছে। তা হলে কারাগার উগ্রবাদী দীক্ষার নিরাপদ জায়গা হয়ে উঠেছে কিনা- এমন প্রশ্নে কমান্ডার মঈন বলেন, বিষয়টি গোয়েন্দা সংস্থা ও কারা কর্তৃপক্ষ, সবাইকে বলা হয়েছে। তারা কাজ করছে।

র‌্যাব জানায়, সেপ্টেম্বর থেকে বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করে কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ হওয়া আটজন তরুণের মধ্যে চারজন ও কেএনএফের সদস্যসহ ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। বর্তমানে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারকস্ফীয়ার আমির আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ। উগ্রবাদী এই সংগঠনে ছয়জন শূরা সদস্য রয়েছেন। তাঁরা দাওয়াতি, সামরিক, অর্থ, মিডিয়া ও উপদেষ্টার দায়িত্বে রয়েছেন। শূরা সদস্য আবদুল্লাহ মাইমুন দাওয়াতি শাখার প্রধান, রনবীর সামরিক শাখার প্রধান, মারুফ আহমেদ সামরিক শাখার সেকেন্ড ইন কমান্ড, মোশারফ হোসেন রাকিব অর্থ ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান, শামীম মাহফুজ প্রধান উপদেষ্টা ও প্রশিক্ষণের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক এবং ভোলার শায়েখ আলেম বিভাগের প্রধান হিসেবে সংগঠনটিতে দায়িত্ব পালন করছেন। এই নতুন জঙ্গি সংগঠনের ৫৫ জন সদস্যকে কেএনএফের প্রধান নাথান বম, সামরিক কমান্ডার কথিত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ভাংচুং লিয়ান বম, মিডিয়া শাখাপ্রধান কথিত লে. কর্নেল লালজং মুই মাওয়াইয়া, কথিত লে. কর্নেল লাল মুন ঠিয়াল চির চির ময়ের সরাসরি তত্ত্বাবধানে পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

র‌্যাব আরও জানায়, অর্থের বিনিময়ে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ, থাকা-খাওয়ার বিষয়ে তিন বছর মেয়াদি লিখিতভাবে চুক্তি হয়। সামরিক প্রশিক্ষণের রূপরেখা নির্ধারণ করেন রনবীর। এক বছর আগে তিনি সামরিক শাখার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পান। এর পর জঙ্গি প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাকে দুই ভাগে ভাগ করেন। একটি অংশকে পার্বত্য এলাকায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। আরেকটি অংশকে সমতলে প্রশিক্ষণ দেন। প্রশিক্ষণ কাজে রনবীর নানা সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে গেছেন। এ ছাড়া আত্মগোপনে থাকার সময় ? সিলেট ও কুমিল্লার বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে সামরিক শাখার সদস্য বাছাই ও নিয়োগ করেছেন। ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে সিলেট থেকে চার তরুণের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় যুক্ত ছিলেন। প্রশিক্ষণ শেষে নিখোঁজ চার তরুণকেই সামরিক শাখায় যুক্ত করেন তিনি। তাঁর নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণের জন্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ কেনা হতো। কিছুদিন আগে আত্মগোপনের জন্য জঙ্গি সংগঠনের বোমা বিশেষজ্ঞ আবুল বাশার মৃধাকে নিয়ে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান নেন।

মৃধার গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের রাজৈরে। এক সময় চট্টগ্রামের হাটহাজারীর একটি মাদ্রাসা থেকে পড়াশোনা করে শিক্ষকতায় যুক্ত ছিলেন। তিনি হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের (হুজিবি) সদস্যও ছিলেন। নাশকতার মামলায় ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিন বছর জেলে ছিলেন বাশার। ২০১৬-১৭ সালের দিকে জামাতুল আনসারের আমির মাহমুদের মাধ্যমে নতুন এই জঙ্গি সংগঠনে যোগ দেন তিনি। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে পাহাড়ে প্রশিক্ষণের জন্য ঘর ছাড়েন। পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছ বিভিন্ন ধরনের বোমা তৈরির বিষয়ে বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষণ নেন। তিনি আইইডিসহ বিভিন্ন ধরনের বোমা বানাতেও দক্ষ।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়