বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫  |   ৩০ °সে

প্রকাশ : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:০০

প্রতিবেশী দেশগুলোতে জেন-জিদের উত্থান, কী করবে ভারত?

প্রতিবেশী দেশগুলোতে জেন-জিদের উত্থান, কী করবে ভারত?
অনলাইন ডেস্ক

নেপালের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি পদত্যাগ করেছেন। সেখানে তরুণদের নেতৃত্বে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। বাইরে থেকে দেখলে এটি হয়তো নেপালের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মনে হতে পারে। কিন্তু ভারতের জন্য এটি কৌশলগত দিক থেকে গুরুতর উদ্বেগের বিষয়। সাম্প্রতিক এসব ঘটনা নয়াদিল্লিকে আমাদের নিকটবর্তী প্রতিবেশীদের ভঙ্গুরতার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।

বিক্ষোভের মূল চালিকাশক্তি ছিল তরুণ প্রজন্ম বা জেন-জি। সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করায় এই বিক্ষোভ শুরু হলেও এর কারণ ছিল আরও গভীরে। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতার সাথে গভীরভাবে জড়িত হতাশার চূড়ান্ত পরিণতি ছিল এটি। কয়েক দশক ধরে নেপালের রাজনীতি কেবলমাত্র অল্প কয়েকজন নেতার হাতে আবর্তিত হয়েছে। তারা ক্ষমতার পালাবদল করেছেন, কিন্তু বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের মতো মৌলিক সমস্যাগুলোর সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

সামাজিক মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা আর মন্ত্রীর গাড়িচাপা

অন্য কথায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত এবং এক মন্ত্রীর গাড়ি চাপায় ১১ বছর বয়সী কিশোরীর মৃত্যুতে বিক্ষোভ শুরু হলেও এর মূলে ছিল দুর্বল রাজনৈতিক কাঠামো, অকার্যকর শাসন এবং তরুণদের হতাশা। দেশটির উচ্চ বেকারত্ব এবং নিম্ন মাথাপিছু আয়ের কারণে অসংখ্য তরুণ বিদেশে কাজের সন্ধানে চলে যাচ্ছেন, যা ক্ষোভ আরও বাড়িয়েছে।

তবে বিক্ষোভে কিছু অনুপ্রবেশকারী ঢুকে পড়ে সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এরপর সেনাবাহিনী কারফিউ জারি করে এবং আলোচনার নেতৃত্ব নেয়। এসময় দেশের প্রেসিডেন্টের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, কারণ তাকে কার্যত ‘নিষ্ক্রিয়’ মনে করা হচ্ছিল।

এই ধরনের বিশৃঙ্খলা ভারতের প্রতিবেশী অঞ্চলে একটি পরিচিত গল্পে পরিণত হয়েছে, যা বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক অস্থিরতার প্রতিধ্বনি। নয়াদিল্লি বুঝতে পারছে, পুরোনো রাজনৈতিক শক্তি, যাদের সঙ্গে ভারত ঐতিহ্যগতভাবে সম্পর্ক রেখেছিল, তারা এখন জনগণের আস্থা হারিয়েছে। তরুণরা নতুন নেতৃত্ব চাইছে, যারা পুরোনো সমস্যার বোঝা বহন করবে না।

বর্তমান পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার দাবি তুলেছে তরুণরা। কারণ তারা বর্তমান এমপিদের অবিশ্বস্ত মনে করছে। ভারতের বুঝতে হবে, নেপালে একটি নতুন রাজনৈতিক প্রজন্মের উত্থান হয়েছে এবং নয়াদিল্লির পুরোনো প্রভাব হয়তো দুর্বল হয়ে আসছে।

ভারতের জন্য সতর্ক বার্তা

নেপালের অস্থিতিশীলতা ভারতের জন্য সরাসরি ও পরোক্ষ হুমকি তৈরি করতে পারে। সবচেয়ে বড় হুমকি হলো নিরাপত্তা। ভারত-নেপাল উন্মুক্ত সীমান্ত একদিকে যেমন সুবিধা তৈরি করে, অন্যদিকে সমস্যার সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়লে চোরাচালান, মানবপাচার এবং ভারতবিরোধী গোষ্ঠীর কার্যক্রম বেড়ে যেতে পারে। নেপালে নিরাপত্তার শূন্যতা পাকিস্তানের আইএসআইয়ের মতো শত্রু গোষ্ঠীগুলোকে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ দেবে।

ভারত কিছু সময়ের জন্য ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটারের সীমান্ত বন্ধ করেছিল। যদিও পরবর্তীতে তা আবার খুলে দেওয়া হয়েছে। তবে সীমান্তে পরিচয় যাচাই ও ড্রোন দিয়ে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এখনো কড়া নজরদারি চলছে।

চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবও উদ্বেগের বিষয়। রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল নেপালে ভারতের প্রভাব হ্রাস পাওয়ার সাথে সাথে চীনের উপস্থিতিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেইজিং তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) এবং সড়ক ও রেলপথসহ বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পের মাধ্যমে নেপালে সক্রিয়ভাবে জড়িত রয়েছে।

অন্যদিকে, নেপালের তরুণ বিক্ষোভকারীরা অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ‘‘ভারতের হাত’’ কিংবা ‘‘চীনের হাত’’ থাকার সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বিগ্ন।

ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাস না করা

ভারতে বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই বলছেন, এসব বিক্ষোভ ‘‘একই ষড়যন্ত্রের অংশ’’, যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে মিলে যায়। অনেকে মনে করছেন, এটি পশ্চিমা শক্তির সমন্বিত কোনও পরিকল্পনা।

তবে আমি বেশিরভাগ ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়েই সন্দিহান। বিশ্ব অনেক সময় অপ্রত্যাশিত ঘটনার মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যা ষড়যন্ত্রকারীরা কল্পনা করেন না। ভারতের অবশ্যই এসব উদ্বেগ মাথায় রেখে পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা উচিত।

কার্কির নিয়োগ

নেপালের নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সুশীলা কার্কির নিয়োগ দেশটির আন্দোলনকে ‘পশ্চিমাদের পরিকল্পিত কালার রেভোলিউশনের’ ধারণাকে দুর্বল করে। কারণ ৭৩ বছর বয়সী কার্কি একজন প্রবীণ আইনজীবী। যিনি রাজতন্ত্রের অবসান এবং দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং ভারতের প্রতি তার ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে। তার বিদেশি শিক্ষা কিংবা যোগাযোগের ঘাটতিতে আমাদের আশ্বস্ত হওয়া উচিত।

বিচারব্যবস্থার ভেতরে থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার লড়াই এবং স্বামীর রাজতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ডই (যার মধ্যে ১৯৭৩ সালের একটি বিখ্যাত বিমান ছিনতাই রয়েছে) প্রমাণ করে, তাকে কেন বেছে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া, তরুণ বিক্ষোভকারীরা গেমিং চ্যাট অ্যাপ ডিসকর্ডে আলোচনার মাধ্যমে তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নিয়েছেন—যা প্রমাণ করে আন্দোলনটি স্বতঃস্ফূর্ত এবং বিশৃঙ্খল ছিল; পরিকল্পিত অভ্যুত্থান নয়।

তারপরও নেপালে স্বল্পমেয়াদে ভারতের সম্পর্কের ওপর প্রভাব পড়তে পারে। এই অস্থিরতা ভারতের গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ করে, জলবিদ্যুৎ খাতের দ্বিপাক্ষিক প্রকল্পগুলোকে স্থগিত কিংবা ব্যাহত করতে পারে। অরুণ-৩ এবং ফুকোট কর্ণালির মতো প্রকল্পগুলো ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক জ্বালানি কেন্দ্র হয়ে ওঠার লক্ষ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এছাড়া বিক্ষোভ চলাকালে প্রায় ৩৩ হাজার বন্দি; যাদের মধ্যে খুনি ও ধর্ষকের মতো গুরুতর অপরাধীরাও ছিলেন—জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই লুট করা অস্ত্রসহ এখন মুক্তভাবে ঘুরছেন, যা বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করেছে।

কী করবে ভারত?

প্রতিবেশী অঞ্চলে চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে কী করতে পারে? নয়াদিল্লির হাতে সীমিত, তবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পথ খোলা রয়েছে। ভারতকে অবশ্যই হস্তক্ষেপ না করার নীতি বজায় রাখতে হবে; যা প্রতিবেশী দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য জরুরি। তবে এটি করতে হবে কৌশলে এবং সূক্ষ্মভাবে, যাতে ভারতের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে।

আমাদের অবশ্যই সরাসরি হস্তক্ষেপ এড়িয়ে চলতে হবে। ভারতকে নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ক্ষুদ্র নিয়ন্ত্রণের প্রলোভনও এড়াতে হবে। ২০১৫ সালের অনানুষ্ঠানিক সীমান্ত অবরোধের মতো কঠোর কূটনীতি অতীত প্রচেষ্টাগুলো পাল্টা প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। দেশটিতে ভারতবিরোধী মনোভাবে উসকানি এবং নেপালকে চীনের আরও কাছাকাছি ঠেলে দিয়েছে। আপাতত দূর থেকে দেখভাল করাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

একই সময়ে আমাদের নেপালের উন্নয়ন এবং ভারতের নিজস্ব ‘‘সফট পাওয়ার’’ ব্যবহারের দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বদলে উন্নয়ন সহায়তা এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক আরও জোরদার করতে হবে।

চলমান প্রকল্পগুলো সময়মতো সম্পন্ন, নেপালের জনগণের সরাসরি উপকারে আসবে এমন নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ, এবং শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়কে উৎসাহিত করতে হবে; এসব উদ্যোগ নেপালের মানুষের মাঝে ভারতের প্রতি আস্থা ও সুনাম তৈরি করবে। এতে দুই দেশের সম্পর্ক ভেতর থেকে মজবুত হবে এবং নেপালি জনগণের দৃষ্টিতে ভারতের মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়বে।

আমাদের অবশ্যই নেপালের নতুন প্রজন্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হবে। নেপালের উদীয়মান রাজনৈতিক নেতা ও তরুণ কর্মীদের সঙ্গে নয়াদিল্লির নতুন যোগাযোগের পথ তৈরি করা উচিত। তাদের স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং ক্ষোভ বোঝা অত্যন্ত জরুরি। কারণ এর ওপরই ভবিষ্যতমুখী পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি গড়ে উঠবে। এই নতুন প্রজন্মকে উপেক্ষা করা হবে বড় এবং গুরুতর ভুল।

সীমান্ত সুরক্ষা

এত কিছুর পর সীমান্ত ব্যবস্থাপনা জোরদার করা ছাড়া আমাদের উপায় নেই। রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হওয়ায় সহিংসতার বিস্তার কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত গোষ্ঠীগুলোর অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ভারতকে নেপালের সঙ্গে উন্মুক্ত সীমান্তে নজরদারি আরও শক্তিশালী করতে হবে।

নেপাল বর্তমানে এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। ভারতের জন্য ঝুঁকির মাত্রা এতটাই বেশি যে, এটিকে আরেকটি ‘‘আবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি’’ হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। নেপালে এই আন্দোলনের পেছনে যে গভীর ক্ষোভ কাজ করছে এবং তার জবাব দিতে হবে একটি সূক্ষ্ম, দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের মাধ্যমে; যেখানে অগ্রাধিকার পাবে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং নিরাপত্তা। আর নেপালের রাজনৈতিক সমাধান দেশটির জনগণের হাতেই ছেড়ে দিতে হবে। নয়াদিল্লিকে অবশ্যই এসব বিষয় অনুধাবন করতে হবে।

নেপালের নতুন সরকারের মূল দায়িত্ব হবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া, আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং তরুণদের বেকারত্ব ও দুর্নীতি মোকাবিলা করা। এরপর কী হবে, তা ভারতের জন্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেটি নির্ধারণের দায়িত্ব ভারতের নয়।

নেপাল আমাদের কাছে শুধু প্রতিবেশী নয়; একটি ভ্রাতৃপ্রতীম দেশ। যার সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতি, ধর্ম, ভৌগোলিক অবস্থান এবং ইতিহাসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তাই ভারতের উচিত হবে হস্তক্ষেপ না করা এবং উদাসীন না থাকার মধ্যে সঠিক ভারসাম্য খুঁজে বের করা। পাশাপাশি নতুন সরকারকে আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তার মাধ্যমে নেপালে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করা। এই ভারসাম্য রক্ষা করা কূটনীতিকদের জন্য সহজ নয়। কিন্তু এটিই সেই কাজ, যার জন্য আমরা করদাতারা তাদের বেতন দিই।

ভারতীয় রাজনীতিক ও কংগ্রেস নেতা শশী থারুরের লেখা নিবন্ধ। শশী থারুর ২০০৯ সাল থেকে কেরালার থিরুভানানথাপুরামের সংসদীয় আসনের আইনপ্রণেতা।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়