প্রকাশ : ০১ জুলাই ২০২৫, ১৪:২২
বিএনপির পররাষ্ট্রনীতি হবে ভারসাম্যপূর্ণ ও বহুপাক্ষিক

ক্ষমতায় গেলে জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে দেশের পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনীতিতে ভারসাম্যপূর্ণ নতুন ধারা চালু করতে চায় বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, কোনো দেশের ওপর একক নির্ভরশীলতা থাকলে দেশের স্বার্থ রক্ষা করা সম্ভব হয় না। তাই আগামীতে বিএনপির কূটনীতির মূল ভিত্তি হবে একক নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে বহুপাক্ষিক সম্পর্ক গড়া।
দলটির নেতারা বলছেন, বিএনপির আগামী দিনের কূটনীতি কেমন হবে তা দলের রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফায় স্পষ্টভাবে বলা আছে। সেখানে বলা আছে বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ, সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া হবে। সমতা, ন্যায্যতা, পারস্পরিক স্বার্থের স্বীকৃতি এবং আন্তর্জাতিক বিধি-বিধান অনুযায়ী দ্বি-পাক্ষিক ও বহু-পাক্ষিক সমস্যার সমাধান করা হবে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ‘একপেশে’ কূটনৈতিক অবস্থান থেকে বেরিয়ে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের পররাষ্ট্র নীতি ‘দেশ ও জনগণের স্বার্থ রক্ষা করে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব’—এই নীতিতে ফিরে যাওয়া হবে।
বিএনপি চেয়ারপার্সনের ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্য ও স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের মাল্টিলেটারাল রিলেশনশিপ। আমরা কখনও একক দেশকেন্দ্রিক নীতি গ্রহণ করি না। বিএনপি যতবারই ক্ষমতায় ছিল, কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল বহুপাক্ষিক। সবার সঙ্গে সম্পর্ক, কোনো এক দেশকেন্দ্রিক নীতি নয়—এটা খুবই পরিষ্কার।’
বিএনপি নেতারা বলছেন, আগামীতে ক্ষমতায় গেলে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা- সার্ককে আবারো পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেবে বিএনপি। সার্কভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়নে জোর দেওয়া হবে। যাতে নিজেদের মধ্যকার আন্তঃসংযোগকে কাজে লাগিয়ে বাণিজ্য সম্প্রসারণ করা যায়। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাণিজ্য, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে বিবেচনায় নিয়ে নীতি প্রণয়ন করা হবে।
দলটির নেতারা আরো বলছেন, সৌদি আরব, কাতার, দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের ১৬টি দেশ বাংলাদেশের অন্যমত শ্রমবাজার। জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার শাসনামলে মধ্যপ্রাচ্যকে আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। মাঝখানে বিএনপির কূটনীতিতে মধ্যপ্রাচ্য কিছুটা উপেক্ষিত ছিল। এখন সেখান থেকে বেরিয়ে আসা হচ্ছে। এখন এসব দেশের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তুলতে নজর দিচ্ছে দল। যাতে এসব দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাণিজ্য, বিনিয়োগের পাশাপাশি শ্রমবাজার সম্প্রসারণে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া যায়।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী বলেন, ‘বিদেশে আমাদের বন্ধু থাকবে, প্রভু থাকবে না। জিয়াউর রহমান সার্ক গঠন করেছিলেন। আমাদের পার্শ্ববর্তী ৭টি দেশ মিলে এটা একটা অ্যাসোসিয়েশন। যেকোনো সমস্যার আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সুন্দর সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু বিগত আওয়ামী লীগ সরকার সার্ককে পুরোপুরি অকার্যকর করেছে। তারা একটা দেশকে প্রাধান্য দিয়েছে। আশা করছি, ভবিষ্যতে সার্ক কার্যকরভাবে সক্রিয় হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের অনেকগুলো পররাষ্ট্রনীতি থাকবে। সেখানে চীনের জন্য একটা পররাষ্ট্রনীতি থাকবে, আমেরিকার জন্য একটা, যুক্তরাজ্যের জন্য আরেকটা এবং পার্শ্ববর্তী দেশের জন্য আলাদা পররাষ্ট্রনীতি থাকবে। ভিন্ন ধরনের বিদেশনীতি দিয়ে জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া কাজ করেছেন। আগামীতে আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও দেশের মানুষ যেন সম্মানবোধ করে সেটাকে ধরে রেখে কাজ করবেন।’
বিএনপির ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির নেতারা বলছেন, একটা সময় বিএনপির প্রকাশ্য অবস্থান ছিল ভারতবিরোধী। সেখান থেকে সরে এসে এখন দেশটির সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী স্থিতিশীল সম্পর্কে আগ্রহী বিএনপি।
আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘পারস্পরিক শ্রদ্ধা, পারস্পরিক স্বার্থ এবং কেউ হস্তক্ষেপ করবে না- এটার ভিত্তির ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক হবে। এই তিনটির ওপর ভিত্তি করে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে যাবে।’
অন্যদিকে বিএনপির বিদেশনীতিতে বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনকে। চীনকে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের পাশাপাশি রাজনৈতিক সম্পর্কও থাকবে। বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর, অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ অর্থনৈতিকভাবে চীনের সহযোগিতা নেওয়ার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হবে।
সম্প্রতি ৫ দিনের চীন সফর শেষে সোমবার (৩০ জুন) এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এক চীন-নীতির প্রতি বিএনপি তার দৃঢ় অবস্থানের কথা জানিয়েছে। সার্বিকভাবে এই সফরের মাধ্যমে আমরা দুই ভ্রাতৃপ্রতিম দেশের বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আরো উন্নত, আরো ঘনিষ্ঠ করার সুযোগ পেয়েছি, যা আগামীতে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আমরা আশাবাদী।
তিনি আরও বলেন, বিএনপি বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, ডিজিটাল প্রযুক্তি, সেমিকন্ডাক্টর, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, মেডিকেল ও স্বাস্থ্যসেবা, উচ্চশিক্ষা, যোগাযোগ, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, এসএমই বিজনেস, ব্লু ইকোনমি, উন্নততর প্রযুক্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে চীনের আরো বেশি ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়েছে।
বিএনপির নেতারা বলছেন, এর আগে বিএনপি দুইবার রোহিঙ্গা সংকট সমাধান করেছে। ১৯৭৮ সালে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং ১৯৯৪ সালে খালেদা জিয়ার সরকার বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করেছিলেন। কিন্তু বিগত আওয়ামী লীগ সরকার রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ‘নির্বিকার’ নীতি গ্রহণ করেছিল। আগামীতে বিএনপি ক্ষমতায় এলে চীন ও ভারতসহ জাতিসংঘ, ওআইসি, আসিয়ান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে মিয়ানমারের ওপর চাপ তৈরি করে প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে সক্রিয় কূটনৈতিক তৎপরতা চালাবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা দুইবার পদক্ষেপ নিয়েছি, তাদের দুইবার ফেরত পাঠিয়েছি। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও বেগম জিয়া ফেরত দিয়েছেন। কিন্তু শেখ হাসিনা তো এটাকে বিপর্যয়কর করে রেখে গেছে। তারা বিভিন্ন দেশকে খুশি করতে গিয়ে রোহিঙ্গা সংকট আরো প্রকট করেছে। সুতরাং আমরা আগের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে সঙ্গে নিয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ তৈরি করে তাদেরকে ফেরত পাঠাবো।’
এদিকে, রোহিঙ্গা শরণার্থীর অবস্থান এবং তাদের প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে চীন সফরে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘আমরা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা নাগরিকদের নিরাপদ, স্বেচ্ছা এবং সম্মানজনক প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে চীনের অধিকতর এবং কার্যকর ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়েছি।’