প্রকাশ : ০৫ আগস্ট ২০২৫, ১১:৪১
ঐতিহাসিক ৩৬ জুলাই: স্বৈরাচার হাসিনার পলায়নের দিন, ঢাকামুখী জনস্রোত

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পর সবচেয়ে শক্তিশালী ও জনসম্পৃক্ত আন্দোলনটি সংঘটিত হয় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে। নজিরবিহীন দমন-পীড়নের কারণে কোটা সংস্কারের দাবি রূপ নিয়েছিল এক দফার আন্দোলনে। সেটি ছিল ‘শেখ হাসিনার পদত্যাগ’। গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থার পতন ঘটে। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পালাবদলের ঘটনা।
আওয়ামী লীগের পতন পর্বের শুরুটা হয়েছিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর সমালোচনা এবং প্রধান বিরোধী দলগুলোর বয়কটের পরও বিতর্কিত নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয় ৭ জানুয়ারি, ২০২৪ সালে। একতরফা এ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবারের মতো নিরঙ্কুশ জয়লাভ করে। যদিও জাতীয় পার্টি ও কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তোলেন।
দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থেকে প্রায় সব বিরোধী দল ও মতকে কোণঠাসা করতে পেরেছিলেন শেখ হাসিনা। শুধু তা-ই নয়, পরপর প্রশ্নবিদ্ধ তিনটি নির্বাচন করেও তিনি পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছিলেন। ফলে জনমনে এমন একটি ধারণা বা ‘মিথ’ প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল যে, শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগকে কিছুতেই ক্ষমতা থেকে সরানো যাবে না। ক্ষমতায় থাকার জন্য জনগণই যে নিয়ামক শক্তি, এ কথা দেশের মানুষ প্রায় অবিশ্বাস করতে শুরু করেছিল। জনগণের পাশাপাশি এক যুগ ধরে আন্দোলন ও মামলা-হামলার মুখে থাকা বিএনপির একাংশের মধ্যেও এমন ধারণা বা বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করেছিল। কারণ, একবার নির্বাচনে অংশ নিয়ে এবং দুবার নির্বাচন বর্জনের পরও কাঙ্ক্ষিত ফল না পাওয়ায় কিছুটা হতাশা তৈরি হয়েছিল দলটির মধ্যে।
তবে, দোর্দণ্ড প্রতাপে টানা চার মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ চালানো সেই শেখ হাসিনাকেই ক্ষমতা ছেড়ে পালাতে হয় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে। ৫ আগস্টের সেই চূড়ান্ত দিনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ গণঅভ্যুত্থান সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি অংশকে প্রবলভাবে ধাক্কা দিয়েছে, অনেক কিছু ভেঙেচুরে দিয়েছে।
বাংলাদেশের এই ঐতিহাসিক রাজনৈতিক পালাবদলের মধ্য দিয়ে কেবল স্থাপনা নয়, প্রচলিত ধারণা, চিন্তা-বিশ্বাস, দর্শন, মূল্যবোধ, গতানুগতিক রাজনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদি বহু ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের আবহ সৃষ্টি করেছে। নতুন এক সম্ভাবনা ও শঙ্কার মুখে দাঁড়িয়ে যখন বাংলাদেশ, তখন কেউ নির্বাচনেই দেখছেন রাজনৈতিক সমাধান। তবে, জুলাইয়ের চেতনা ও জনাকাঙ্ক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে সংস্কার, দৃশ্যমান বিচার শুরুর পরই নির্বাচনের পক্ষে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল।
একদিন এগিয়ে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির ঘোষণা আসে ৪ আগস্ট
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ছিল মূলত ৬ আগস্টে। তবে, ৪ আগস্ট বিকেলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ নিজের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে দেওয়া এক বার্তায় তা একদিন এগিয়ে এনে ৫ আগস্ট কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন।
নতুন কর্মসূচি নিয়ে ফেসবুকে তিনি লেখেন, “পরিস্থিতি পর্যালোচনায় এক জরুরি সিদ্ধান্তে আমাদের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ৬ আগস্ট থেকে পরিবর্তন করে ৫ আগস্ট করা হলো। আগামীকালই (৫ আগস্ট) সারা দেশের ছাত্র-জনতাকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করার আহ্বান জানাচ্ছি।”
আসিফ লেখেন, ‘আজ অর্ধশতাধিক ছাত্র-জনতাকে খুন করা হয়েছে। চূড়ান্ত জবাব দেওয়ার সময় এসে গেছে। বিশেষ করে আশপাশের জেলাগুলো থেকে সর্বোচ্চ উপস্থিতি নিয়ে সবাই ঢাকায় আসবেন এবং যারা পারবেন আজই ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়ে যান। ঢাকায় এসে মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা রাজপথগুলোতে অবস্থান নিন।’
সেদিন আসিফের ভাষ্য ছিল, ‘চূড়ান্ত লড়াই, এই ছাত্র-নাগরিক অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত স্বাক্ষর রাখার সময় এসে গেছে। ইতিহাসের অংশ হতে ঢাকায় আসুন সকলে। যে যেভাবে পারেন কালকের মধ্যে ঢাকায় চলে আসুন। ছাত্র-জনতা এক নতুন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটাবে।’
‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঠেকাতে কঠোর হয় সরকার
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঠেকাতে সরকার অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ ঘোষণা করে। একই সঙ্গে তিন দিনের (৫, ৬ ও ৭ আগস্ট) সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এ অবস্থায় ৫ আগস্ট সকাল থেকে রাজধানীর সড়কগুলো ছিল ফাঁকা। মূল সড়কে মানুষের চলাচল ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তথ্যানুসন্ধানী প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঠেকাতে পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আগের দিন (৪ আগস্ট) তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দুই দফায় উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়। পুলিশের এক কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনার পতনের বিষয়ে পরদিন (৫ আগস্ট) সকাল থেকেই সেনাবাহিনী অবগত ছিল। কিন্তু পুলিশ জানত না বলে সরকারকে রক্ষা করতে তখনো সর্বাত্মকভাবে মাঠে ছিল।
জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫ আগস্ট ঢাকার কেন্দ্রস্থলে বড় প্রতিবাদ মিছিলের পরিকল্পনার কথা নেতাদের প্রকাশ্য ঘোষণা এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য থেকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব জানতে পারেন। বিষয়টি নিয়ে ৪ আগস্ট সকালে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠক হয়। সেখানে সেনা, বিমান, নৌ, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই, পুলিশ ও পুলিশের বিশেষ শাখার প্রধানেরা ছিলেন। হাসিনা সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বৈঠকে অংশ নেন। তারা ‘মার্চ টু ঢাকা’ প্রতিরোধের জন্য আবার কারফিউ জারি ও তা বলবৎ করার বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
বৈঠকের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা দেয়, কোনো বিরতি ছাড়াই অনির্দিষ্টকালের জন্য কঠোর কারফিউ চলবে। আন্দোলনকারীদের সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী একটি বিবৃতি দেন। ‘এই সন্ত্রাসীদের শক্ত হাতে দমন’ করতে তিনি দেশবাসীকে আহ্বান জানান।
৪ আগস্ট সন্ধ্যার পর গণভবনে আরেকটি বৈঠক করেন শেখ হাসিনা। সেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, র্যাব ও আনসার/ভিডিপির প্রধান, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার ও সেনাবাহিনীর কোয়ার্টারমাস্টার জেনারেল উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে সেনাপ্রধান ও অন্যান্য নিরাপত্তা কর্মকর্তা ঢাকা রক্ষার বিষয়ে আবারও হাসিনাকে আশ্বস্ত করেছিলেন।
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করে বিক্ষোভকারীদের ঢাকার কেন্দ্রস্থলে প্রবেশে বাধা দিতে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েন করার বিষয়ে বৈঠকে ঐকমত্য হয়েছিল। সেনাবাহিনী ও বিজিবি সাঁজোয়া যান ও সেনা মোতায়েন করে ঢাকায় প্রবেশের পথগুলো অবরুদ্ধ করবে, বিক্ষোভকারীদের প্রবেশে বাধা দেবে। অন্যদিকে, পুলিশ ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে নিয়ন্ত্রণ’ করবে।
শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনী স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) তৎকালীন মহাপরিচালক ৫ আগস্ট প্রথম প্রহরে (রাত ১২টা ৫৫ মিনিট) বিজিবির মহাপরিচালককে পরপর দুটি হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা পাঠান। সেই বার্তাগুলোর হার্ড কপি পেয়েছে ওএইচসিএইচআর। এসবের তথ্য অনুসারে, প্রথমটি ছিল আন্দোলনের নেতাদের ফরোয়ার্ড করা সম্প্রচারিত বার্তা। এতে তারা ঢাকায় প্রবেশের পথগুলো সম্পর্কে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে জানিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বার্তাটিতে প্রতিরক্ষা নির্দেশনার রূপরেখার একটি ভিডিও রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এতে প্রতিরক্ষার প্রথম ও দ্বিতীয় লাইন, একটি তৃতীয় দূরপাল্লার ইউনিট, একটি ব্যাকআপ ইউনিট, একটি পশ্চাদ্ভাগের বাহিনীর কথা বলা হয়েছে।
ঐতিহাসিক ৩৬ জুলাই (৫ আগস্ট) যা ঘটেছিল
ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, ঢাকার উদ্দেশে জনস্রোত শুরু হয়। উত্তরা-আব্দুল্লাহপুর, টঙ্গি থেকে হেঁটেই ছাত্র-জনতার স্রোত সামনে এগিয়ে আসতে থাকে। উত্তরায় আটকাতে না পেরে খিলক্ষেত ও বনানী এলাকায় পুলিশ চেষ্টা করে জনস্রোত ঠেকানোর জন্য। তবে, সেটা সম্ভব হয়নি।
কারণ, ৫ আগস্ট সকালে সেনাবাহিনী ও বিজিবির সদস্যরা মূলত দাঁড়িয়েছিলেন। আগের রাতে সরকারের করা পরিকল্পনা অনুযায়ী, তারা অর্পিত ভূমিকা পালন করেননি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার সাক্ষ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেনা মোতায়েন করা হয়নি। আরেকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, বিজিবি প্রতি ঘণ্টায় বিভিন্ন প্রবেশপথ দিয়ে প্রায় ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার বিক্ষোভকারীকে ঢুকতে দিয়েছে, যা তাদের নিয়ন্ত্রণ করার কথা ছিল।
পরিস্থিতি নিয়ে এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ভিডিও ফুটেজে ৫০০ থেকে ৬০০ বিক্ষোভকারীকে সেনাবাহিনীর বাধা ছাড়াই উত্তরা থেকে ঢাকার কেন্দ্রস্থলের দিকে আসতে দেখে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কিছু একটা গড়বড় হচ্ছে। চতুর্থ আরেকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে জানান, পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হচ্ছে না।
বিজিবি-সেনাবাহিনী বুঝলেও পুলিশ তখনও ছুড়ছিল গুলি
বিক্ষোভকারীদের শহরের কেন্দ্রস্থলে পৌঁছাতে বাধা দিতে তখনো পুলিশ অনেক জায়গায় গুলি চালাচ্ছিল। পুলিশের একজন কর্মকর্তার ভাষ্য, ‘সেদিন সকাল থেকেই সেনাবাহিনী জানত, শেখ হাসিনার পতন হয়ে গেছে। কিন্তু পুলিশ জানত না। তাই পুলিশ তখনো সরকারকে রক্ষা করতে সর্বাত্মকভাবে মাঠে ছিল।’
রাজধানীর চানখারপুলে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের কর্মকর্তারা ও অন্য পুলিশ সদস্যরা রাইফেল থেকে প্রাণঘাতী গুলি করে। শাহবাগের দিকে অগ্রসর হতে চেষ্টা করা বিক্ষোভকারীদের থামাতে তারা প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে। পুলিশ যাকে পাচ্ছিল তাকে লক্ষ্য করেই গুলি চালায়। সেদিন চানখারপুল এলাকাতেই গুলিতে মারা যান অন্তত সাতজন। ঘটনাটি চানখারপুল গণহত্যা নামে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি পায়।
কারফিউ ভঙ্গ
সকাল ১০টার পর থেকে কারফিউ ভঙ্গ করে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে রাস্তায় নেমে আসেন ছাত্র-জনতা। সকাল ১০টার দিকে রামপুরা ব্রিজ পার হয়ে বাড্ডায় যাওয়ার চেষ্টা করলে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ও টিয়ারশেল ছোড়ে পুলিশ। এতে শিক্ষার্থী-বিক্ষোভকারীরা আহত হন। ওই এলাকায় সকালে গুলিতে আহত বেশ কয়েকজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অন্যদিকে, সকাল ১০টার আগে ও পরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জড়ো হন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও জনতা। পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল ও গুলি করে তাদের সরিয়ে দেয়।
বেলা ১১টার দিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাসহ ছাত্র-জনতা গণভবনের দিকে এগোনোর চেষ্টা করে, পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে জড়িয়ে পড়েন সংঘর্ষে। কয়েকটি স্থানে পুলিশ সরাসরি গুলি চালায়।
যাত্রাবাড়ীতে হাজারো মানুষ রাস্তায়
ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকায় হাজারো মানুষ রাস্তায় অবস্থান নেন। যাত্রাবাড়ী থানা এলাকায় অবস্থান নেয় পুলিশ। সাঁজোয়া যানসহ সেনাবাহিনীর সদস্যদের দেখা যায় সেখানে। বেলা ১১টায় পুলিশ বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে।
ইন্টারনেট শাটডাউন
সরকারের নির্দেশে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ইন্টারনেট শাটডাউন করা হয়। অন্যদিকে, বেলা ১১টার পর ঢাকার উত্তরায় বিএনএস সেন্টারের সামনে হাজারো আন্দোলনকারী রাস্তায় অবস্থান নেন। দুপুর ২টার দিকে ছাত্র-জনতা গণভবন ও সংসদ ভবন এলাকায় প্রবেশ করেন।
বার্তা সংস্থা এএফপি এক প্রতিবেদনে জানায়, চলমান পরিস্থিতিতে দেশ ছেড়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুপুর আড়াইটায় একটি সামরিক হেলিকপ্টারে শেখ হাসিনা উড্ডয়ন করেন। এ সময় তার ছোট বোন শেখ রেহানা সঙ্গে ছিলেন। শেখ হাসিনা যাওয়ার আগে একটি ভাষণ রেকর্ড করে যেতে চেয়েছিলেন। তবে, তিনি সে সুযোগ পাননি।
বিকেল ৩টায় সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বিটিভিতে ঘোষণা দেন– শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন এবং দেশ ছেড়েছেন। পরে সেনা সদর দপ্তরে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।
২৪ ঘণ্টার মধ্যে সব বন্দির মুক্তি দাবি
২৪ ঘণ্টার মধ্যে আন্দোলন ঘিরে গ্রেপ্তার হওয়া সব বন্দির মুক্তির দাবি জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। সংবাদ সম্মেলনে ডেকে তিনি বলেন, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমরা একটি অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকারের প্রস্তাব করব। সেই জাতীয় সরকারে অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-নাগরিকদের অংশ থাকবে এবং নাগরিক সমাজসহ বিভিন্ন পেশাজীবী ও বিভিন্ন পক্ষ থাকবে। সবার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে তাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে আমরা অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকারের রূপরেখা এবং সেই সরকারে কারা কারা থাকবেন তাদের নাম ঘোষণা করব।
রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে সেনাপ্রধানের বৈঠক
প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন জানিয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বিকেলে বলেন, এখন রাজনৈতিক ক্রান্তিকাল চলছে। একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হবে। সব হত্যার বিচার হবে। সেনাবাহিনীর ওপর আস্থা রাখেন। আমরা রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি।
জনগণের উদ্দেশে সেনাপ্রধান বলেন, দেশে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখেন। আপনারা আমার ওপর আস্থা রাখেন, একসাথে কাজ করি। দয়া করে সাহায্য করেন। মারামারি, সংঘাত করে আর কিছু পাব না। সংঘাত থেকে বিরত হোন। সবাই মিলে সুন্দর দেশ গড়ি।
ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, আমরা মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে যাব। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিষয়ে ওনার সঙ্গে কথা বলব। তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনা করা হবে।
সব হত্যা ও অন্যায়ের বিচার হবে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, আপনারা সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি আস্থা রাখেন। আমরা সমস্ত দায়দায়িত্ব নিচ্ছি। আপনাদের কথা দিচ্ছি, আশাহত হবেন না। যত দাবি আছে, সেগুলো আমরা পূরণ করব। দেশে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে নিয়ে আসব। আমাদের সহযোগিতা করেন। প্রতিটি হত্যার বিচার হবে।
ভাঙচুর, হত্যা, সংঘর্ষ ও মারামারি থেকে জনগণকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে সেনাপ্রধান বলেন, ‘আসুন, একসঙ্গে কাজ করি। নিঃসন্দেহে সুন্দর পরিণতির দিকে অগ্রসর হতে পারব। মারামারি ও সংঘাত করে আর কিছু পাব না। তাই দয়া করে ধ্বংসযজ্ঞ, অরাজকতা ও সংঘর্ষ থেকে বিরত হন। সবাই মিলে সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে আমরা অগ্রসর হব।’
গণভবনে ঢুকে পড়েন অসংখ্য মানুষ
শেখ হাসিনার পতন হয়েছে— এমন খবরে গণভবনে ঢুকে পড়েন অসংখ্য মানুষ। তারা গণভবনের মাঠে উল্লাস প্রকাশ করেন। এ সময় অনেকের হাতে গণভবনে ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিস দেখা যায়।
মোবাইল ইন্টারনেট চালু
একদিন বন্ধ থাকার পর দুপুর ২টার পর মোবাইল ইন্টারনেট চালু হয়। এর আগের দিন সকালে কয়েক ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পুনরায় চালু হয়।
সংখ্যালঘুদের রক্ষায় গ্রামেগঞ্জে শিক্ষার্থীদের দাঁড়ানোর আহ্বান
গ্রামেগঞ্জে, পাড়া-মহল্লায় সংখ্যালঘুদের রক্ষায় শিক্ষার্থীদের দাঁড়ানোর আহ্বান জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ। ৫ আগস্ট রাতে এক ব্রিফিংয়ে হান্নান মাসউদ বলেন, আমি এ দেশের ছাত্র-জনতাকে বলব প্রতিটি জায়গায়, প্রতিটি গ্রামেগঞ্জে, প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় আমাদের সংখ্যালঘু ভাই-বোনদের রক্ষার্থে সকলে দাঁড়িয়ে যান, যাতে কেউ ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে না পারে।
দানবের হাত থেকে জাতি মুক্তি পেল : ফখরুল
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে দানবের হাত থেকে জাতি মুক্তি পেয়েছে।’ বঙ্গভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, অবিলম্বে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে হবে। সেই সঙ্গে গত কিছুদিনে যত রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে জেলে পাঠানো হয়েছে তাদেরও মুক্তি দিতে হবে।
ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপাসনা-বাড়ি রক্ষায় শিবিরের আহ্বান
ছাত্র-জনতার বিজয়ের পর দেশবাসীকে শৃঙ্খলা বজায় রাখার আহ্বান জানায় বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। ৫ আগস্ট এক যৌথ বিবৃতিতে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি মঞ্জুরুল ইসলাম ও সেক্রেটারি জেনারেল জাহিদুল ইসলাম বলেন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, রাজনৈতিক সহনশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা রক্ষা; সর্বোপরি একটি সোনার বাংলা বিনির্মাণের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে দেশপ্রেমিক জনতাকে ঐক্যবদ্ধভাবে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
বিবৃতিতে নেতারা বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় আপামর সচেতন নাগরিকদের প্রতি কিছু আহ্বান ব্যক্ত করেন– স্বৈরাচার থেকে মুক্ত করার জন্য সালাতের মাধ্যমে সবাই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করুন। দেশে দ্রুত শান্তি ফিরিয়ে আনতে সবাই সহযোগিতা করুন। যারা জুলুমকারী আছে, তাদের শাস্তি দেশের মাটিতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে তার মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে। দেশের সব সরকারি সম্পদের মালিক জনগণ। তাই কোনো সরকারি সম্পত্তি যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেগুলো সুরক্ষার দায়িত্ব প্রত্যেকেরই নিতে হবে। দেশের সব ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের মধ্যে যে চমৎকার সম্প্রীতি রয়েছে তা যেন কোনোভাবেই নষ্ট না হয় সেদিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে।
রাতে ইসলামী আন্দোলনের আমির এক বিবৃতিতে বলেন, জালিম ও দুর্নীতিগ্রস্ত এক নৃশংস স্বৈরশাসকের কবল থেকে জনগণ মুক্তি পেয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। এখন সময় দেশ গড়ার, নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের। সাম্য, সামাজিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার ভিত্তিক সমৃদ্ধ রাষ্ট্র নির্মাণের সংগ্রামে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি।
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে রাজনৈতিক নেতা ও তিন বাহিনীর প্রধানদের বৈঠক
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সভাপতিত্বে সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের লক্ষ্যে সেনাপ্রধান, নৌপ্রধান ও বিমান বাহিনীর প্রধান এবং দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে কোটাবিরোধী আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে শোক প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং তাদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করা হয়।
রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব জয়নাল আবেদীন জানান, বৈঠকে অনতিবিলম্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। সভায় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সবাইকে ধৈর্য ও সহনশীল আচরণ করার আহ্বান জানানো হয়। সেনাবাহিনীকে লুটতরাজ ও হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বলা হয়। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অনতিবিলম্বে মুক্তির সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সম্প্রতি বিভিন্ন মামলায় আটক সব বন্দিকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি যেন কোনোভাবেই বিনষ্ট না হয় সে ব্যাপারেও সভায় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও মির্জা আব্বাস, জামায়াতে ইসলামের আমির ড. শফিকুর রহমান ও শেখ মো. মাসুদ, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের, মুজিবুল হক চুন্নু ও আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, হেফাজতে ইসলামের মামুনুল হক, মুফতি মনির কাসেমী ও মাহাবুবুর রহমান, মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে রাব্বি, জাকের পার্টির শামিম হায়দার, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মাওলানা জালাল উদ্দীন আহমদ, গণসংহতি আন্দোলনের জুনায়েদ সাকি, গণঅধিকার পরিষদের অ্যাডভোকেট গোলাম সারওয়ার জুয়েল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুল, ফিরোজ আহমদ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল্লাহ আল হোসাইন, আরিফ তালুকদার, ওমর ফারুক ও মোবাশ্বেরা করিম মিমি এবং ইঞ্জিনিয়ার মো. আনিছুর রহমান।