প্রকাশ : ২৫ আগস্ট ২০২৫, ১৩:১৭
আট বছরেও রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরানো যায়নি

‘ভিটে মাটি ছেড়ে এই দেশে এসেছি। কিছু আত্মীয়-স্বজন ছিল তারাও চলে এসেছে কিছুদিন আগে। আমাদের কোনো কিছুর কমতি ছিল না সেখানে, অথচ আজ ত্রিপলের নিচে জীবন কাটাতে হচ্ছে।’ কথাগুলো বলছিলেন উখিয়ার কুতুপালং ৩নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা মোহাম্মদ ইয়াসিন উল্লাহ (৩৫)।
৮ বছর আগে এই দিনে রাখাইনের মংডুর সিকদার পাড়া থেকে পালিয়ে ৭ দিন পায়ে হেঁটে মা-বাবাসহ জীবন বাঁচাতে সীমান্ত পেরিয়ে তিনি এসেছিলেন বাংলাদেশে।
শুধু ইয়াসিনই নয়, নিজ দেশ মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর নিপীড়নের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী তিন মাসে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ উপজেলায় নতুন করে আশ্রয় নেয় প্রায় ৮ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। প্রায় তিন হাজার দিন অতিবাহিত চললেও এই মানুষগুলোর নিজ দেশে ফেরার যাত্রা তথা প্রত্যাবাসনের পথ হয়নি সুগম।
বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘের সমন্বিত তথ্য বলছে, বর্তমানে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১৩ লাখেরও বেশি।
বর্তমানে রাখাইনে বিরাজ করছে ‘অনিশ্চিত পরিবেশ’, যে প্রেক্ষাপট কার্যত শুরু হয় ২০২৩ সালের নভেম্বরে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে।
২০২৪ সালের ডিসেম্বর আরকান আর্মি ঘোষণা দেয় তারা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী রাখাইনের ২৭১ কিলোমিটার এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে।
বিরাজমান সংঘাত পরিস্থিতিতে রাখাইনের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত দুই টাউনশিপ মংডু,বুথিডং থেকে গত ১৮ মাসে প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে বলে সম্প্রতি জানিয়েছে জাতিসংঘ।
সর্বশেষ চলতি মাস আগস্টে আবারো বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা সীমান্তের ওপারে জড়ো হয়েছে বাংলাদেশে ঢুকতে, অনুপ্রবেশের এই শঙ্কায় যেন উঁকি দিচ্ছে আরেকটি নতুন ২৫ আগস্ট।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি জানিয়েছে, গেল ৫ দিনে অন্তত ৩ শতাধিক রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশে বাঁধা দেওয়া হয়েছে।
বিজিবির টেকনাফ ২ ব্যাটেলিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান বলেন, আমরা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছি। কোনোভাবেই যেন নতুন কেউ আসতে না পারে সে লক্ষ্যে সীমান্তের ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে শক্ত নজরদারির পাশাপাশি টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে।
রোহিঙ্গা সংকটে নানা সমস্যায় জড়িত স্থানীয়রাও রয়েছেন আতঙ্কে, তারা বলছেন প্রত্যাবাসন নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং অনুপ্রবেশ দমাতে হবে।
উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের ইউপি সদস্য ইঞ্জিনিয়ার হেলাল উদ্দিন বলেন, আমরা এই সংকটের সমাধান চাই, কোনোভাবেই রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না। আশ্রিতদের ক্যাম্পের বাইরে অনিয়ন্ত্রিত বিচরণসহ অপরাধ রুখতে সরকারকে কঠোর হতে হবে।
অন্যদিকে অনুকূল অবস্থার মাঝের বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো আশার সঞ্চার করেছে রোহিঙ্গাদের মাঝে।
গত রমজানে জাতিসংঘের মহাসচিবসহ ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ইফতার করতে এসে প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূসের দেওয়া ‘আগামী বছর ঈদের আগে ঘরের ফেরার’ আশ্বাস মনে রেখে আশায় বুক বেঁধেছেন রোহিঙ্গারা।
রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার জুবায়ের বলেন, আমরা বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞ, ড. ইউনূস আমাদের নতুন করে উজ্জীবিত করেছেন। আমরা আশাবাদী বাংলাদেশ যে পথে হাঁটছে, বিশ্ব আবার আমাদের নিয়ে নতুন করে ভাববে।
রোববার প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের উদ্যোগে শুরু হয়েছে রোহিঙ্গাদের নিয়ে বড় পরিসরের তিন দিন ব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলন।
সোমবার (২৫ আগস্ট) দ্বিতীয় দিনে এই সম্মেলনের একটি অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিতি থাকবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস।
প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার সম্মেলনের প্রথমদিনে সাংবাদিকদের বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার চেষ্টা করছে কীভাবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথ উন্মুক্ত করা যায় পাশাপাশি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণের লক্ষ্য নিয়ে এই সম্মেলন আয়োজন করা হয়েছে।
শুধু রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনের বক্তব্যে বৈশ্বিক রোহিঙ্গা রাজনৈতিক প্লাটফর্ম - আরকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল কাউন্সিল (এআরএনসি)র সহ সভাপতি নেই সান লুইন, বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতা ও প্রত্যাবাসনের পথ উন্মোচনের প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, আশা করছি বাংলাদেশের এই আয়োজনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের আওয়াজ পৌঁছে যাবে যে আমরা নিরাপদ, মর্যাদা এবং অধিকার নিয়ে মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে মুখিয়ে আছি।
১০৭ দেশের অংশগ্রহণে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদর দপ্তরে অনুষ্ঠাতব্য রোহিঙ্গা বিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলনের প্রস্তুতি হিসেবে অংশীজনদের সঙ্গে কক্সবাজার সম্মেলনকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
ইউএনএইচসিআর-এর যোগাযোগ কর্মকর্তা মোশারফ হোসেন বলেন, আমরা রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিস্থিতির উপর দৃষ্টি ধরে রাখার এবং সংকটের মূল কারণগুলো সমাধানের জন্য যেকোনো প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানাই।
তিনি আরও বলেন, সংকটের সমাধান মিয়ানমারে নিহিত, এবং রোহিঙ্গারা যখন পরিস্থিতি অনুকূল হবে, তখন স্বেচ্ছায়, নিরাপদে এবং মর্যাদার সঙ্গে তারা বাড়িতে ফিরতে পারবে।
এছাড়া পরবর্তী সময়ে ৬ ডিসেম্বর রোহিঙ্গা বিষয়ক তৃতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন কাতারে অনুষ্ঠিত হবে বলে সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।