বুধবার, ০৬ আগস্ট, ২০২৫  |   ২৭ °সে

প্রকাশ : ০৫ আগস্ট ২০২৫, ১৯:৩১

ছাত্র আন্দোলন থেকে গণবিস্ফোরণ, যে কারণে ১৬ বছরের স্বৈরশাসনের পতন

ছাত্র আন্দোলন থেকে গণবিস্ফোরণ, যে কারণে ১৬ বছরের স্বৈরশাসনের পতন
অনলাইন ডেস্ক

বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন ৫ আগস্ট। ২০২৪ সালের এই দিনে প্রায় ১৬ বছর ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটেছিল এক নজিরবিহীন গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া একটি ছোট ছাত্র আন্দোলন কীভাবে জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণে রূপ নিয়ে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে কাঁপিয়ে দিল, কী কারণে এটি হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির অনুঘটক হয়েছিল, সরকারের প্রতিক্রিয়া কতটা ভুল ছিল এবং নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা কীভাবে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছিল— সবগুলো বিষয় নিচে তুলে ধরা হলো...

কোটা সংস্কার থেকে গণঅভ্যুত্থান

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের বীজ বপন হয়েছিল বহু আগে। কিন্তু এর প্রত্যক্ষ কারণ হয়ে ওঠে ‌‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া এই আন্দোলন প্রথমে শান্তিপূর্ণ ছিল। দেশের উচ্চ আদালত থেকে কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালের রায়ের পর এই আন্দোলন নতুন করে তীব্রতা পায়। শিক্ষার্থীরা মনে করছিল, এই ব্যবস্থা তাদের মেধার অবমূল্যায়ন করছে।

আন্দোলনের ক্রমবিকাশ

প্রাথমিক পর্যায় (জুন-জুলাই ২০২৪): আন্দোলন শুরু হয় প্রধানত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে।

সরকারের দমন-পীড়ন: সরকার প্রথমদিকে এই আন্দোলনকে গুরুত্ব দেয়নি। বরং একে উসকানিমূলক বলে আখ্যায়িত করে। আন্দোলন দমনে পুলিশ, র‌্যাব ও ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মীদের ব্যবহার করা হয়। আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা, লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ এবং গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটে। এই দমন-পীড়নই ছিল টার্নিং পয়েন্ট। যখন আন্দোলনকারীরা দেখল যে, তাদের শান্তিপূর্ণ দাবিকে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে না এবং উল্টো সহিংসতা চালাচ্ছে, তখন তাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

এক দফা দাবিতে উত্তরণ: দমন-পীড়নের প্রতিবাদে এবং নিহত ও আহত শিক্ষার্থীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন ‘আর কোনো কথা নয়, এক দফা; শেখ হাসিনার পদত্যাগ’ স্লোগানে রূপ নেয়। ওই মুহূর্তে আন্দোলনটি শুধু কোটা সংস্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে একটি সর্বাত্মক সরকারবিরোধী গণআন্দোলনে পরিণত হয়।

অসহযোগ আন্দোলন: আন্দোলনকারীরা অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়। এর রূপরেখা ছিল, কোনো ধরনের কর বা বিল পরিশোধ না করা, সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত বন্ধ রাখা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ রাখা এবং প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ রাখা। এই অসহযোগের ডাক দেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলে।

সরকার পতনের গভীর কারণ

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গণঅভ্যুত্থান হলেও এর পেছনে আরও গভীরে ছিল নানা কারণ এবং দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত অসন্তোষ। এই অসন্তোষের উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হচ্ছে—

১. ব্যাপক দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাব: শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি ও অর্থপাচারের অভিযোগ ছিল। বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয়, কমিশন বাণিজ্য এবং ক্ষমতার অপব্যবহার জনমনে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি করে। ব্যাংক লুট, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি এবং সরকারি কর্মকর্তাদের মাত্রাতিরিক্ত বিলাসবহুল জীবনযাপন সাধারণ মানুষকে হতাশ করে তুলেছিল। প্রশাসনের সর্বস্তরে জবাবদিহিতার অভাব এবং আইনের শাসনের অনুপস্থিতি সুশাসনের অভাবকে প্রকট করে তোলে।

২. অর্থনৈতিক চাপ ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি: উচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি এবং জ্বালানি সংকটের কারণে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। কর্মসংস্থানের অভাব বিশেষত শিক্ষিত তরুণ সমাজের মধ্যে ব্যাপক হতাশা সৃষ্টি করে, যা তাদের আন্দোলনমুখী করে তোলে।

৩. গণতান্ত্রিক স্থানের সংকোচন ও ভিন্নমত দমন: সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে, তারা বিরোধী মতকে কঠোর হাতে দমন করছিল। সভা-সমাবেশের ওপর বিধিনিষেধ, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গণগ্রেপ্তার এবং সমালোচকদের বিরুদ্ধে মামলার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক স্থান সংকুচিত করা হয়েছিল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো আইনগুলো সাংবাদিক, ব্লগার ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সীমিত করা হয় এবং স্বাধীন সাংবাদিকতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।

৪. পুলিশ ও দলীয় ক্যাডারদের সহিংসতা: আন্দোলন দমনে পুলিশ, র‌্যাব এবং ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র ও যুব সংগঠনের কর্মীদের সহিংস ভূমিকা ছিল অন্যতম প্রধান কারণ। নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচার গুলি, লাঠিপেটা এবং নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে, বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের ওপর সরাসরি গুলি চালানোর ঘটনা জনমনে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়। আহত ও নিহতদের সংখ্যা বাড়তে থাকায় পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হতে থাকে।

সরকারের প্রতিক্রিয়া: আন্দোলন যখন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল তখন সরকারের প্রতিক্রিয়া ছিল ত্রুটিপূর্ণ এবং আত্মঘাতী। প্রথমদিকে সরকার আন্দোলনকে ছোট করে দেখেছিল এবং এর পেছনে ‘ষড়যন্ত্র’ রয়েছে বলে অভিযোগ তোলে। এই মনোভাব আন্দোলনকারীদের আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে।

দমন-পীড়নে জোর: আলোচনার পরিবর্তে সরকার শক্তি প্রয়োগের পথ বেছে নেয়। এতে পরিস্থিতি আরও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া হয়, যা তথ্যপ্রবাহকে সীমিত করে পরিস্থিতিকে আরও অস্থিতিশীল করে তোলে।

কারফিউ ও জরুরি অবস্থা: বিভিন্ন স্থানে কারফিউ জারি করা হয়। কিন্তু তা উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। সরকারের দমনমূলক পদক্ষেপগুলো বরং আন্দোলনকে আরও বেগবান করে এবং জনরোষকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যায়।

প্রধানমন্ত্রীর অসহযোগিতা: ৫ আগস্ট সকালে যখন গণভবনের দিকে জনস্রোত ধাবিত হয়, তখনও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগের ব্যাপারে অনমনীয় ছিলেন বলে জানা যায়। তবে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত তিনি পদত্যাগ করেন এবং দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেন।

নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা: ৫ আগস্টের ঘটনাবলিতে নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত বিতর্কিত। আন্দোলনের প্রথম দিকে পুলিশ ও র‌্যাব কঠোর হাতে আন্দোলন দমনের চেষ্টা করে। তারা টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট এবং সরাসরি গুলি ব্যবহার করে। ফলে অসংখ্য হতাহতের ঘটনা ঘটে।

সেনাবাহিনীর ভিন্ন অবস্থান: যখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং পুলিশ ও র‌্যাব জনগণের রোষের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয়, তখন সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিরপেক্ষ হতে শুরু করে। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এক বিবৃতিতে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলেন, যা সরকারের পতনে একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

গণহত্যা ও জবাবদিহিতা: আন্দোলন চলাকালীন নিহতদের সংখ্যা এক হাজারের বেশি এবং আহতদের সংখ্যা শত শত বলে দাবি করা হয়। এই গণহত্যাকাণ্ডের জন্য পরবর্তীতে শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিসভার সদস্য, উপদেষ্টা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়।

সংকটচিত্র ও ৫ আগস্টের চূড়ান্ত পর্যায়: গত বছরের ৫ আগস্ট সকালে ঢাকার রাজপথ ছিল জনসমুদ্রে পরিণত। লাখ লাখ মানুষ ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে অংশ নিতে গণভবন অভিমুখে রওনা দেয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা এই জনস্রোত সবরকম বাধা উপেক্ষা করে সামনে অগ্রসর হয়।

গণভবন অবরোধ: আন্দোলনকারীরা গণভবনের দিকে এগিয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবন কার্যত জনতা দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।

আকস্মিক পদত্যাগ: দুপুরের দিকে খবর আসে যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। তিনি তার ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে সামরিক হেলিকপ্টারে করে ভারতে পালিয়ে যান। একটানা প্রায় ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা সরকারের আকস্মিক পতন গোটা বিশ্বকে স্তম্ভিত করে দেয়। একটি ছাত্র আন্দোলন কীভাবে দেশের প্রচলিত রাজনৈতিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে একটি গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হতে পারে, তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়।

বিজয় উল্লাস: প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়তেই সারা দেশে বাঁধভাঙা বিজয় উল্লাস শুরু হয়। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে এবং মুক্তির আনন্দে মেতে ওঠে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন: শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর সেনাপ্রধানের মধ্যস্থতায় অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। এই সরকার অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দেয়।

৫ আগস্ট পরবর্তী পরিস্থিতি

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সৃষ্টি হয়। যদিও কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে, তবে ৫ আগস্টের পর বড় ধরনের রাজনৈতিক সহিংসতা কমে আসে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা পুনর্বিন্যস্ত করতে কাজ শুরু করে।

বিচার ও জবাবদিহিতা: সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রিসভার সদস্য এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলা দায়ের করা হয়। দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু হয়। অনেকে গ্রেপ্তার হন, আবার অনেকে বিদেশে পালিয়ে যান।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: বিশ্ব সম্প্রদায় বাংলাদেশের এই পরিবর্তনকে সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করে এবং একটি স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন জানায়।

নানা মহলের দাবি, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট কেবল একটি সরকারের পতন ছিল না, এটি ছিল বাংলাদেশের জনগণের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে একটি ঐতিহাসিক প্রতিরোধ। এটি প্রমাণ করেছে যে, জনগণের ঐক্যবদ্ধ শক্তি যেকোনো স্বৈরাচারী শাসনকে উৎখাত করতে পারে। এই ঘটনা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হয়ে থাকবে এটি।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়